শনিবার ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছিলেন বাবুল তার বধলে দিতে হল জীবন

প্রকাশিতঃ ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬  

পুলিশী হয়রানি বন্ধ ও নিজের স্বাভাবিক জীবনযাপন ও নিরাপত্তা চেয়ে মিরপুর বিভাগ পুলিশের কাছে আবেদন করেছিলেন বাবুল মাতব্বর। কিন্তু পুলিশের কাছ থেকে নিরাপত্তা পাননি তিনি। হয়রানি তো চলছিলই উল্টো বিভিন্ন সময় পুলিশ জোরপূর্বক চাঁদাও নিয়ে গেছে। নিরাপত্তা চেয়ে আবেদনের ৬ মাস পার না হতেই নিরাপত্তার বদলে সোর্স-পুলিশেরই আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন বাবুল। নিহত বাবুলের পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও স্থানীয় বাসিন্দারা এ দাবি করেছেন।
সূত্রে জানা গেছে, শাহ আলী থানা এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী পারুলের মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন বাবুল মাতুব্বর। দীর্ঘদিন মাদকের স্পটে জড়িত থাকাকালীন বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। মাস ছয়েক আগে থেকে মিরপুরের ডিসিকে লিখিত মুচলেকা দিয়ে মাদক ছেড়ে চায়ের দোকান দেন বাবুল। এর পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক্সের মিস্ত্রি হিসেবে কাজও করতো বাবুল।
শাহ আলী থানাধীন গুদারাঘাট সংলগ্ন কাজীফুরি কিংশুক সিটির পাশেই ছিল বাবুলের চায়ের দোকান। সেখানেই গত বুধবার রাতে পুলিশ আর সোর্সের দেয়া আগুনে পুড়ে ঝলসে যান বাবুল।
নিহতের মেয়ে রোকসানা আক্তার বলেন, বাবা আগে মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পৌনে এক বছর আগে ওই পেশা ছেড়ে চায়ের দোকান দেয়। কিন্তু আগের জের ধরে পুলিশ বাবাকে হয়রানি করতে থাকে। অথচ বাবা ডিসি বরাবর লিখিত মুচলেকা দিয়েই কিন্তু চায়ের দোকান দিয়েছিল।
মেয়ে রোকসানা আরো জানান, এরপর গত বছরের ১৬ আগস্ট আবারো ডিসি বরাবর পুলিশী হয়রানি বন্ধ ও স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেন। পুলিশের উপর বিশ্বাস ছিল তাই বাবা ডিসিকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কে জানতো এভাবে বাবাকে পুলিশ পুড়িয়ে মারবে।
বরাবর বাবুলের নিরাপত্তা চেয়ে লেখা আবেদনের একটি কপি এসেছে । বাবুলের স্বাক্ষর করা সেই আবেদনের কপিতে উল্লেখ করা হয়, ‌‘আমি বাবুল মাতব্বর ইলেক্ট্রনিক্সের কাজসহ যখন যে কাজ পাইতম সে কাজ করেই কোনো রকম পরিবার নিয়ে দিন যাপন করছি। আমি কোনো মাদক খাইও না এবং বিক্রয়ও করি না। লোক মারফত শুনতে পাই, আশেপাশের ঘরের লোকজন নাকি মাদক বিক্রয় করে। উক্ত ঘরে মাদক বিক্রেতাদের খুঁজতে এসে পুলিশ আমাকে নানাভাবে হয়রানি করে।’
আবেদন কপির শেষে বাবুরের আর্জি ছিল, ‘পুলিশ আবারো হয়রানি শুরু করেছে। ফলে আমি সব সময় পুলিশের ভয়ে থাকি। থানা পুলিশ অন্য কাউকে খুঁজতে গিয়ে যেন আমাকে হয়রানি না করে এজন্য শাহ আলী থানাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান এবং আমাকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার সুযোগ দানে আপনার মর্জি হয়।’
কিংশুক এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাবুল পারুলের মাদক স্পটের কাজ ছেড়ে দিলেও পারুল বাবুলকে ছাড়েনি। সে বাবুলকে মাদক ব্যবসায় ফেরাতে না পেরে পুলিশকে দিয়েই তাকে পুড়িয়ে মেরেছে।
বাবুলের বড় ছেলে মো. রাজু বলেন, ‘মাদক স্পট ছেড়ে দেয়ায় পারুলের সঙ্গে বাবার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পারুল ও বাবুলের বাড়ি একই গলিতে। বছর খানেক আগে ৯০ কেজি গাঁজাসহ পারুল পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। জেল থেকে জামিনে বেড়িয়ে পারুল পুনরায় মাদক ব্যবসা শুরু করে। তার ধারণা ছিল বাবুলই তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে পারুল পুলিশের সহায়তায় বার বার আমাদের পরিবারকেই হেনস্তা করেছে। মাদকসেবি ও বিক্রেতারা মাদক কিনতে আসতো পারুলের কাছে। আর ভোগান্তিতে পড়তে হতো আমাদের।’
তিরি আরো অভিযোগ করে বলেন, ‘পারুলের টাকায় পুলিশ চুপ থাকতো। তার কাজে কোনো বাধা দিতো না। কিন্তু হয়রানি করতে বাবাকে। পুলিশ সোর্সদের দিয়ে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা চাঙ্গা রেখেছিল।’
ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলমান ভাবমূর্তিতে ভীষণ বিব্রত পুলিশ। আর সে কারণে কঠিন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ডিএমপি। এরই অংশ হিসেবে ডিএমপি বৃহস্পতিবারই বরখাস্ত হয়েছে শাহ আলী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মমিনুর রহমান, এসআই নিয়াজউদ্দিন মোল্লা, সহকারী এসআই জোগেন্দ্রনাথ ও কনস্টেবল জসিম উদ্দিন। এরপর শুক্রবার বিকেলে প্রাথমিক তদন্তে থানার ওসির গাফিলতির প্রমাণ পেয়ে তাকেও প্রত্যাহার করে নেয়।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, শুধুমাত্র দু-একজন পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অপকর্মের কারণে পুরো পুলিশ বিভাগকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। ইতোমধ্যে শাহ আলী থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ঘটনায় দোষী পুলিশ সদস্যদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী মোটর চালক লীগের এক যুগপূর্তি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান এসব কথা বলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মারুফ হাসান সরদার বলেন, তিনি জাগো নিউজকে জানান, ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে শাহ আলী থানার ওসি একেএম শাহীন মণ্ডলকেও শুক্রবার প্রত্যাহার করেছেন। বুধবারের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
একই ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত করতে দুটি কমিটি গঠন করে পুলিশ। এর মধ্যে একটি পুলিশের মিরপুর বিভাগ এবং অপর কমিটি করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হেড কোয়ার্টার্স।
পুলিশের মিরপুর বিভাগের তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন- অতিরিক্ত ডিসি মাসুদ আহমেদ ও সহকারী কমিশনার (এসি) মাহবুব হোসেন। ডিএমপির তদন্ত কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে ডিসি (ডিসিপ্লিন) টুটুল চক্রবর্তীকে।